খুলনা, বাংলাদেশ | ২৩ পৌষ, ১৪৩১ | ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  গুম ও জুলাই গণহত্যায় জড়িত ৯৭ জনের পাসপোর্ট বাতিল
  ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ভারতে আছেন শেখ হাসিনা, ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রেস ব্রিফিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

সামনে আসছে হাসিনা-ঘনিষ্ঠের দেওয়া টিউলিপের একের পর এক ফ্ল্যাটের তথ্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক সামনে আসছে তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনের সম্পদের খবর। শেখ পরিবারের সদস্য ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে উপহার দেওয়া আরেকটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে সরাসরি দেওয়া হয়নি। এটি তাঁর ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিকের নামে বিনামূল্যে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী। উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটিতে বসবাস এবং ঠিকানা হিসেবে ব্যবহারও করতেন টিউলিপ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এর আগে ২০০৪ সালেও লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট টিউলিপ উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন বলে গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানায় ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। ফ্ল্যাটটি উপহার দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আবাসন ব্যবসায়ী আবদুল মোতালিফ। যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথি অনুযায়ী, ওই ফ্ল্যাটের জন্যও কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয়নি টিউলিপকে। ফ্ল্যাটটি ২০০১ সালে ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে কেনা হয়। বর্তমান দাম নথিতে উল্লেখ না থাকলেও একই ভবনের আরেকটি ফ্ল্যাট গত আগস্টে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ (৪২) বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। ওই সময় চালানো গণহত্যা, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাঁর বিচার শুরু করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এই অভিযোগের মধ্যে অন্তত ৮০০ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর বিষয়টি আছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগও রয়েছে।

শেখ হাসিনা পরিবারের যেসব সদস্য সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে টিউলিপও আছেন। তবে তিনি কোনো অন্যায়-অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, টিউলিপের ওপর তাঁর আস্থা রয়েছে।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি ২০০৯ সালে আজমিনাকে হস্তান্তর করেন বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি আছে। যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন-সংক্রান্ত নথিপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ বা আর্থিক মূল্য রয়েছে এমন কিছু ছাড়াই ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে দেওয়া হয়েছে। ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় আজমিনার বয়স ছিল ১৮ বছর। তখন তিনি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন।

টিউলিপ ঠিক কখন ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ ওয়ার্কিং মেনস কলেজের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি নথিতে তাঁর ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটি তালিকাভুক্ত করেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্যামডেন আর্টস সেন্টারের ট্রাস্টি এবং ওই বছরের মার্চে হ্যাম্পস্টেড ওয়েলস অ্যান্ড ক্যাম্পডেন ট্রাস্টের ট্রাস্টি হওয়ার পরও তিনি একই ঠিকানা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তাঁর স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত এটিকে তাঁর ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন। তখন টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার এমপি ছিলেন।

টিউলিপের বোন আজমিনা সম্প্রতি শিশুদের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন। টনি ব্লেয়ারস ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি ফ্ল্যাটটি ২০২১ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেন।

ফ্ল্যাটটির আগের মালিক আইনজীবী মঈন গণি আন্তর্জাতিক বিরোধ-সংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক বছর বাংলাদেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকার বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলে দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার কাছ থেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ-সংবলিত একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাওয়াটা তাঁর জন্য সম্মানের বিষয়।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি থেকে আলাদা। কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি ২০০৪ সালে টিউলিপ বিনামূল্যে পান। তিনি এখনও এই অ্যাপার্টমেন্টটির মালিক।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটির বিষয়ে টিউলিপ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁর বোনের এই ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করেছিলেন, যা অনেক পরিবারের জন্য সাধারণ একটি বিষয়।

২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তিতে টিউলিপ মধ্যস্থতা করেছেন। এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন বলে যে অভিযোগ, তা সম্প্রতি অনুসন্ধান শুরু করেছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই প্রকল্প থেকে ৪০০ কোটি পাউন্ড আত্মসাৎ করেন, এমন অভিযোগে টিউলিপকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ডেইলি মেইল এক প্রতিবেদনে বলেছে, টিউলিপ দুই বছর আগে তাঁর সাড়ে ৬ লাখ পাউন্ড মূল্যের ফ্ল্যাট উপহারের বিষয়ে মিথ্যা বলেছিলেন। সেই সময় তিনি অ্যাপার্টমেন্টটি উপহার হিসেবে পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে দাবি করেন, এটি তাঁর বাবা-মা তাঁকে কিনে দিয়েছিলেন। টিউলিপ তখন এ অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। মিথ্যা বক্তব্যের বিষয়ে লেবার পার্টির সূত্র জানিয়েছে, কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি মূলত সেই আবাসন ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে ‘কৃতজ্ঞতার প্রতীক’ হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।

এসব খবরের পর টিউলিপের ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়ছে। শনিবার রাতে কনজারভেটিভ এমপিরা টিউলিপকে উদ্দেশ করে বলেন, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা না করলে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করুন।

হ্যারো ইস্টের টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেন, টিউলিপ সিদ্দিককে তাঁর সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। প্রথমে তিনি কী বলেছিলেন এবং কেন বলেছিলেন। যদি তিনি তা না করেন, তাহলে তাহলে মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান অগ্রহণযোগ্য।

ছায়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ম্যাট ভিকার্স বলেন, সরকারের যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ অগ্রহণযোগ্য। আর স্টারমারের দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন এমন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তা আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

লেবার পার্টির সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালে প্রথম এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে সিদ্দিকের পরিবার জানায়, ফ্ল্যাটটি একটি বাড়ি বিক্রির অর্থ থেকে কেনা হয়েছিল। তবে গত সপ্তাহে টিউলিপের পরিবারের সেই বক্তব্য পরিবর্তিত হয়েছে।

এদিকে, আওয়ামী লীগের সদস্যদের মালিকানাধীন বা উপহার পাওয়া বাড়িতে টিউলিপ ও তাঁর পরিবারের বসবাস করার ঘটনা শুধু এই দুটিই নয়।

২১ লাখ পাউন্ডের ম্যানসন

টিউলিপ উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলেতে ২১ লাখ পাউন্ডের একটি ম্যানসনে থাকেন। এটি আগে লরেন পোপ নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল। তিনি একজন রিয়েলিটি টিভি তারকা। দুই বছর আগে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল করিম নাজিমের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি ওই ম্যানসনটি কিনে নেয়। নাজিম ২০২২ সালে টিউলিপের কাছে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। পরের বছর তিনি শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে তখন বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (সিআইপি) সম্মান দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তিনি শেখ হাসিনার দলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ব্যাংকের উপ-চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।

তবে ২০২৩ সাল থেকে দেশটিতে নাজিমের পাঁচটি কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, তারা সময়মতো বা সম্পূর্ণরূপে হিসাব জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

একটি সূত্র বলেছে, টিউলিপ নিরাপত্তার কারণে নাজিমের বাড়িতে ওঠেন। নিরাপত্তার কারণেই সেখানে তিনি থাকছেন। টিউলিপের মুখপাত্র বলেন, তিনি ও তাঁর স্বামী বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে ভাড়া দিয়ে থাকেন।

গোল্ডার্স গ্রিনে ১২ লাখ পাউন্ডের বাড়ি

টিউলিপের মা শেখ রেহানা উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনে একটি বাড়িতে থাকেন। অনুসন্ধানী সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট নেত্র নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, ১২ লাখ পাউন্ড মূল্যের ওই বাড়ির মালিক সায়ান রহমান। তিনি শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে। শেখ হাসিনার পতনের পর সায়ান রহমানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একটি ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়। তাঁর বাবা এখন কারাগারে আছেন।

হ্যাম্পস্টেডে ৫ লাখ পাউন্ডের ফ্ল্যাট

টিউলিপের বোন ও মা হ্যাম্পস্টেডের উল্লিখিত ফ্ল্যাটটির কাছের একটি ফ্ল্যাটে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফর উল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি এটি ২০০৭ সালে কিনেছিলেন। ২০১২ সালে ৪ লাখ ৯৯ হাজার পাউন্ডে এটি তিনি বিক্রি করে দেন। আশ্চর্যজনকভাবে আইনজীবী গণিও এটিকে কয়েক বছর ধরে তাঁর ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।

২০০৭ সালে যখন এটি কেনা হয়, জাফর উল্লাহকে বাংলাদেশে চাঁদাবাজির জন্য কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে তাঁকে একটি অফশোর ট্রাস্টের নেটওয়ার্কের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!